শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

অপার সম্ভাবনার হাওর অবহেলায় বিপর্যস্ত

হাওর হলো বিশাল বাটি বা গামলা আকৃতির ভূ-গাঠনিক অবনমন বা নোয়ানো অবস্থা। হাওর শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘সাগর’-এর বিকৃত রূপ বলে ধারণা করা হয়। বর্ষাকালে হাওরে পানিরাশির ব্যাপ্তি এত বেশি থাকে যে দেখে মনে হয় তীরহীন সমুদ্র। প্রধানত বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে হাওর দেখা যায়। এই হাওরগুলো নদী ও খালের মাধ্যমে জলপ্রবাহ পেয়ে থাকে। শীতকালে হাওরগুলো বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে রূপ নেয়। জেগে ওঠা উর্বর জমিতে শুরু হয় ফসলের আবাদ। গরু-মহিষের পাল ঘুরে বেড়ায় বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে। ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকে হাওর এলাকার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলা হয়, দেশের ৪১১টি হাওরের মধ্যে ৪৬টি থেকেই বছরে ৭০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন সম্ভব। আর সবকটি হাওরকে উন্নয়নের আওতায় আনা গেলে শুধু হাওরাঞ্চল থেকে উৎপাদিত ফসল দিয়েই সারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চাল রফতানি করা যেতে পারে। (সূত্র : সংবাদ, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭)
একসময় মেঘনা ও এর শাখানদীগুলো দ্বারা গঠিত পাবনভূমির স্থায়ী ও মৌসুমি হ্রদ নিয়েই গঠিত হয়েছিল হাওর অববাহিকা, যেখানে প্রচুর বৈচিত্র্যপূর্ণ জলজ উদ্ভিদ থাকত। কিন্তু ধারাবাহিক অবপেণের কারণে অববাহিকাগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে চরা জেগে সেখানে হোগলা ও নলখাগড়ার ঝোপ গজিয়ে ওঠে। এর ফলে একদিকে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয়ের আদর্শ স্থান হয়ে ওঠে হাওর অঞ্চলগুলো, অন্যদিকে যাযাবর পাখিদের আকর্ষণীয় আবাসস্থলে পরিণত হয়। আবার যাযাবর পাখিদের মলমুত্রে সমৃদ্ধ হয়ে উর্বর জলমহালগুলো উদ্ভিদ-প্লাঙ্কটন (phytoplankton) ও দীর্ঘ লতাগুল্মের জন্ম দেয়, যা ইউট্রোফিকেশন (পানির নিচে প্রচুর উদ্ভিদ জন্মানো) প্রক্রিয়াকে অংশত সাহায্য করছে।
অববাহিকাটি উত্তরে মেঘালয় পর্বতমালা (ভারত), দক্ষিণে ত্রিপুরার পাহাড় (ভারত) এবং পুবদিকে মণিপুরের (ভারত) উচ্চভূমি দিয়ে ঘেরা। বিশাল এই পলিগঠিত সমভূমিতে ছয় হাজারের বেশি স্থায়ী অগভীর জলমহাল রয়েছে, যেগুলো বিল নামে পরিচিত।
পার্শ্ববর্তী ভারতের অসংখ্য পাহাড়ি নদী এই পলিভূমিতে প্রচুর পানি সরবরাহ করে। বর্ষাকালে ৬ মিটার পর্যন্ত গভীর বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল। শুকনো মৌসুমে অধিকাংশ পানি সরে যায়। দু-একটি বিলের অগভীর পানিতে গজিয়ে ওঠে প্রচুর পরিমাণ বৈচিত্র্যময় জলজ উদ্ভিদ। টানা খরা মৌসুমের শেষ দিকে পানি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে অতি উর্বর পলিমাটির বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ব্যাপক ধান চাষের তোড়জোড় চলে। এই অববাহিকায় রয়েছে প্রায় ৪৭টি বড় হাওর এবং বিভিন্ন মাপের প্রায় ৬ হাজার ৩০০ বিল। এগুলোর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার স্থায়ী এবং ২ হাজার ৮০০ অস্থায়ী বা ঋতুভিত্তিক বিল।
সুরমা, কুশিয়ারার সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য ছোটখাট পাহাড়ি নদী, যেমন- মনু, খোয়াই, যাদুকাটা পিয়ান, মগরা প্রভৃতি সংযুক্ত হয়েছে হাওরের ঘন জলনির্গম প্রণালীর সঙ্গে। হাওরের সঙ্গে সংযুক্ত সমভূমির বাকি অংশ বন্যায় পাবিত হয় প্রায় ৭ থেকে ৮ মাসের জন্য। বর্ষাকালে হাওরগুলো পরিবর্তিত হয় বিশাল অন্তর্দেশীয় সমুদ্রে, যার ফলে গ্রামগুলোকে দেখা যায় দ্বীপের মতো। কখনো কখনো জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জোরে বাতাস থেকে উৎপন্ন হয় বিশাল ঢেউয়ের পর ঢেউ, যা বসতবাড়ির জন্য য়তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পুরো সুনামগঞ্জ জেলা, হবিগঞ্জ জেলার বড় অংশ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মৌলভীবাজার জেলার অংশবিশেষসহ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল এবং কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বড় অংশ হাওর দিয়ে বেষ্টিত। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ হাওরগুলো হলো- শনির হাওর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, ডাকের হাওর, মাকার হাওর, ছাইয়ার হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, কর্চার হাওর, চন্দ্র সোনারতাল এবং কাওয়া দীঘি হাওর। বৃহত্তর ময়মনসিংহের উলেখযোগ্য হাওরগুলো হলো- ডিঙ্গাপোতা, নাওটানা, চর হাইজদিয়া, লক্ষ্মীপাশা, কীর্তনখোলা, লক্ষ্মীপুর, গোবিন্দডোবা, চাকুয়ার হাওর, জোয়ানশাহী।
হাওরগুলোকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল জলাভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্যাপক জীববৈচিত্র্য ধারণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরণে হাওরের গুরুত্ব অপরিসীম। স্থায়ী ও পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে হাওরগুলো সুপরিচিত। বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর হাওরে প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন প্রকার ছোট-বড় মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে জেগে ওঠে পশুচারণভূমি। হাওর এলাকা অতিথি পাখিদের সাময়িক বিশ্রামত্রে হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিচিত্র ধরনের জলজ পাখিসহ অসংখ্য হাঁসের আবাসস্থল ছাড়াও বহু বন্য প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল এইসব হাওর। এই জলাভূমির বনাঞ্চলে একসময় জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ, যেমন- হিজল ( Barringtonia acutangula), করচ ( Ponogamia pinnata), বরুণ ( Crataeva nurvala), ভুই ডুমুর ( Ficus heterophyllus), জলডুমুর (এক ধরনের Ficus), হোগলা ( Typha elephantina) নল ( Arundo donax), খাগড়া ( Pharagmites karka), বনতুলসী ( Ocimum americanum), বলুয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে জন্মাত।
জীববৈচিত্রের এই পৃথিবীতে জলাভূমি হলো সবচেয়ে উর্বর। একটি গম ক্ষেতের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি সবুজ উদ্ভিদ জন্মায়। বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ মাছের জোগানও আসে হাওর-বাঁওর-বিল জাতীয় জলাভূমি থেকে। পানির প্রাকৃতিকচক্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও জলাভূমি। পানির দূষণ এবং দবীভূত পলি মুক্ত করতে, উদ্ভিদ জন্মাতে মিঠা পানির সরবরাহচক্রে জলাভূমির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হাওরাঞ্চলকে ভাটি এলাকাও বলা হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্যে বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধশালী জনপদ হিসেবে পরিচিত এই এলাকা। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তেরো শতকের মাঝামাঝি আসামের কামরূপ থেকে নদীপথে এসেছিলেন হবিগঞ্জে। সেখান থেকে ভাটি এলাকার ওপর দিয়ে গিয়ে পৌঁছেছিলেন সোনারগাঁয়। ওই ভ্রমণের সময় ভাটি এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করে। বজরাসহ পাল তোলা হরেক রকমের নৌকা, নদীতীরের গ্রাম-গঞ্জ, হাটবাজার, গাছপালা দেখে মুগ্ধ হন তিনি। অকুণ্ঠ প্রশংসাও করেন এ অঞ্চলের নিসর্গের।
এককালে এ অঞ্চলের হাওর ও নদী থেকে তোলা উৎকৃষ্ট মুক্তা রফতানি হতো সুদূর ইউরোপে। এখানকার ঘি, মাখন, পনির ইত্যাদির খ্যাতি ছিল ভারতবর্ষজুড়ে। রফতানিও হতো এসব নানা দেশে। হাওরাঞ্চলের মিঠা পানির মাছের মতো এমন সুস্বাদু মাছ অন্য কোনো দেশে পাওয়া কঠিন।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে হাওরগুলো হুমকির সম্মুখীন। মাটিভরাট করে হাওরে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি, হাওরের প্রান্তিকভূমিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে বোরো চাষ, কেটে ফেলা হচ্ছে হাওরের বৃরাজি, সেইসঙ্গে বিলুপ্তি ঘটছে প্রাণিজগতের।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিস সূত্রের বরাত দিয়ে ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭০ সালের আগেই জেলায় মাছের বার্ষিক উৎপাদন ছিল গড়ে এক লাখ টনের বেশি। ১৯৭২-৭৩ সালে উৎপাদন ছিল ৯৫ হাজার টন। ১৯৯০-৯১ সালে তা নেমে আসে ৪০ হাজার টনে। ’৯১-৯২ সালে তা আরো কমে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার টন। প্রতিবেদনে জেলায় মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার জন্য পলি জমে হাওর ও নদী ভরাট হওয়া এবং ইজারার শর্ত উপো করে বিল শুকিয়ে ইজারাদারদের মাছ ধরাকে দায়ী করা হয়।
সমস্যা জর্জরিত এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের নানা সমস্যার কথা সংবাদ মাধ্যমে কিংবা উপন্যাস, নাটক, সিনেমায় কোনো না কোনোভাবে উঠে এলেও হাওরবাসীর জীবন-জীবিকা ও সমস্যার কাহিনী এতকাল ছিল দেশের মানুষের অজানা। দেরিতে হলেও ইদানীং এ নিয়ে কথাবার্তা কিছু হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমেও উঠে আসছে নানা বিষয়। দেশে তো বটেই, এমনকি বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের প্রোপটে ২০০৮ সালে বোরোর বাম্পার ফলন দেশবাসীর জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক বটে। আর এ প্রোপটেই হাওর অঞ্চলের উন্নয়ন ইস্যুটিও বিশেষ গুরুত্ববহ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাত জেলার ৪৮টি উপজেলার ২০ হাজার ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ২ হাজার ৪১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে হাওর অঞ্চল। বছরের অর্ধেক সময় হাওরগুলো বহমান পানিতে ডুবে থাকায় জমিতে পলি জমে তা হয়ে ওঠে উর্বর। শুকনো মৌসুমে সেচসুবিধা নিশ্চিত করাসহ পরিকল্পিত উপায়ে চাষ করতে পারলে এবং বৈশাখে আগাম বন্যার হাত থেকে রা করা গেলে এ অঞ্চল থেকে শুধু একটি ফসলের মাধ্যমেই কমপে যে-পরিমাণ চাল উৎপাদন করা সম্ভব, তা দিয়ে গোটা দেশের খাদ্য চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে উৎপাদন করা যেতে পারে বিপুল পরিমাণ মাছ, যা দিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়েও বছরে কয়েক শ’ কোটি টাকার মাছ রফতানি করা সম্ভব। মুক্তাসহ ঝিনুক চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা না-ইবা বললাম। যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে এগুলে পর্যটন এলাকা হিসেবেও এ অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ।
ধান ও মাছ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনাময় হাওর অঞ্চলের দিকে এতকাল নজরই পড়েনি জাতীয় নীতিনির্ধারকদের। নজর যেটুকু পড়েছে তা শুধু হাওরে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দিকেই। প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় হাওরে বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য; কিন্তু তাতে কাজের কাজ তেমন হয়নি। আসলে পাহাড়ি ঢল বা আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল রার কৌশলটি আমাদের জাতীয় উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্কিত। গত কয়েক দশকে সব সরকারই মূলত আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর পরামর্শে (যা নির্দেশের চেয়ে কম নয়) রেল ও নৌপথকে উপো করে সড়ক যোগাযোগের দিকে যেমন মনোযোগ দিয়েছে, তেমনি বন্যা মোকাবিলায়ও গুরুত্ব দিয়েছে বাঁধ নির্মাণ তথা ‘ঘেরাও’ পদ্ধতিকে। বর্তমানে এই যে খাদ্য সংকট, এটি মূলত পরিবেশ বিপর্যয় এবং আমদানিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থারই পরিণাম। বিশ্বের সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের ভূমিকা তেমন উলেখযোগ্য না হলেও সামান্য বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা ও বন্যা এবং পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসলহানি রোধ করতে না পারাটা আমাদের ‘ঘেরাও’ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যর্থতারই ফল। খাদ্য নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকির মুখে বর্তমানে যখন কৃষিখাতের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে, তখন আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গিটিও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
দেশের নদ-নদী ও জলাশয় ব্যাপক হারে ভরাট হওয়া এবং শুকিয়ে যাওয়ায় ফসল ও মাছ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতিও অচিরেই প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়বে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান ২০০৮ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কৃষি ও মৎস্য খাতে নদী ধ্বংসের সরাসরি প্রভাব পড়ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বছরে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মৎস্য কম উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে দূষণের কারণে কম হচ্ছে ২ হাজার কোটি টাকা। আর শুকিয়ে যাওয়ার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা।’ কোনো গবেষণা ছাড়া সাদা চোখেই দেখা যায়, নদী শুকিয়ে গেলে অববাহিকা অঞ্চলের মাটিও শুকিয়ে যায়। আর নদী-নালা শুকিয়ে যাওয়ায় সেচের জন্য নির্ভর করতে হয় ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর। তাতে খরচও পড়ে বেশি। এছাড়া ক্রমাগতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে নতুন বিপর্যয় নেমে আসে পরিবেশের ওপর। কাজেই আমাদের কৃষি অর্থনীতি ও পরিবেশ রার জন্য নদ-নদী রার কোনো বিকল্প নেই। অনেক বিশেষজ্ঞও এর সঙ্গে একমত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সারফেস ওয়াটার হাইড্রোলজি সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শওকত আলী ২০০৮ সালের ৮ মার্চ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘উজানের নদীগুলোর পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। খনন বা পুনঃখনন করে প্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়। এক্ষেত্রে ছোট ছোট নদীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বড় নদীগুলোর খনন এ মুহূর্তে সম্ভব নয়।’
নদী খননের কথা উঠলেই আমাদের নীতিনির্ধারকরা একে ব্যয়বহুল আখ্যা দিয়ে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। অথচ এটা না করায় খননজনিত খরচের চেয়ে কত বেশি লোকসান বা তি হচ্ছে সে হিসাব খতিয়ে দেখার চেষ্টাও তারা করেননি। বেসরকারি সম্ভব সিএনআরএসের এক সমীায় বলা হয়, ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ বছরে শুধু সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যায় বোরো ফসলের তি হয়েছে ৫৮৭ কোটি ১২ লাখ ১৮ হাজার টাকার। অন্যান্য সূত্রের হিসাবে অবশ্য তির পরিমাণ অনেক বেশি। ২০০৪ সালের মে মাসে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের সহায়তায় ঢাকায় জাতীয় প্রেস কাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘হাওরবাসী রক্ষায় নাগরিক উদ্যোগ’-এর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই বছর এপ্রিলে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জে বোরো ফসলের তি হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকার। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালের এপ্রিলের বন্যায় ওই জেলায় ফসলডুবিতে বেসরকারি হিসাবে ২০০ কোটি টাকা তি হয়েছিল। অবশ্য সরকারি হিসাবে তির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। পাহাড়ি ঢলে প্রায় বছরই বোরো ফসলের একই রকম তি হয়ে থাকে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরাঞ্চলেও। কাজেই তির পরিমাণ যে বছরে কয়েক শ’ কোটি টাকার কম নয় তা বলাই বাহুল্য।
গত ২৫ ডিসেম্বর বার্তা সংস্থা ইউএনবির এক খবরে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অকাল বন্যায় আগামী বছরগুলোতে হাওরাঞ্চলের বোরো উৎপাদন আশঙ্কাজনক মাত্রায় কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বড় ধরনের খাদ্য সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর রাবাঁধগুলোর উচ্চতা বাড়ানো এবং নদী খননের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডবিউএম) নির্বাহী পরিচালক এমদাদ উদ্দিন আহমেদ ইউএনবিকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন পঞ্জিকার সময়ের আগেই বর্ষকাল শুরু হয়ে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বোরো ফসল কাটার মৌসুমে (এপ্রিল-জুন) ভারি বৃষ্টিতে হাওরগুলো আরো বেশি করে জলমগ্ন হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে আগাম বন্যা একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। ফলে বোরো উৎপাদন ব্যাপকভাবে তিগ্রস্ত হবে।
খবরে বলা হয়, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার প্রায় ৫৭টি হাওর দেশের বোরো ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ শস্য নষ্ট হয়। এমদাদ উদ্দিনের মতে, জলবায়ু যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে কৃষকরা সময়মতো চাষ শুরু করলেও ফসল তোলা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। পাহাড়ি এলাকায় ভারি বৃষ্টি হলেই বন্যায় তাদের ফসল তলিয়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে ফসল বাঁচাতে হাওর রাবাঁধগুলোর উচ্চতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এস এম শেখ নেওয়াজ জানান, ২০৫০ সাল নাগাদ হাওর এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এখনকার তুলনায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়বে। হাঠাৎ ভারি বৃষ্টির কারণে আগাম বন্যাও বাড়বে। তিনি জানান, হাওর এলাকার নিকটবর্তী ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বছরে প্রায় ১৪ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দিনগুলোতে আসাম ও মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরো বাড়বে। সেই বৃষ্টির পানি পাহাড়ি ঢল হয়ে নেমে আসবে বাংলাদেশের হাওরগুলোতে। বৃষ্টিপাত বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ওই অঞ্চলের নদীগুলোর পানির উচ্চতা দশমিক ৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। আর তাহলে বর্ষাকালে নেমে আসা পানি আর বেরোতে পারবে না। ফলে হাওরগুলোতে সৃষ্টি হবে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘বোরো মৌসুমে শস্য বাঁচাতে হলে হাওর রাবাঁধগুলোর উচ্চতা এক থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে উৎপাদিত ধানের একটি বড় অংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। এ অবস্থায় আমরা হাওর এলাকার বোরো উৎপাদন নিশ্চিত করতে না পারলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে বড় ধরনের খাদ্য সংকট দেখা দেবে।’
আইডবিউএমের এক সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের হাওরগুলোর পানির উচ্চতা প্রাকবর্ষা মৌসুমে দশমিক ৩ থেকে দশমিক ৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের কর্চার হাওরের পানির উচ্চতা দশমিক ৩ মিটার এবং সিলেটের জিলকর ও মৌলভীবাজারের কাওয়ারদীঘি হাওরের পানির উচ্চতা দশমিক ৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবে।
এ কারণে ইউএনবির ওই প্রতিবেদনে হাওর রাবাঁধগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ডুবো বাঁধগুলোর নকশায় পারিবর্তন আনা এবং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ছয় জেলার ৪৬টি হাওর রার জন্য ৩৬৭ কিলোমিটার ডুবোবাঁধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিস্তৃত হাওর এলাকার ফসল বাঁচাতে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি সমন্বিত প্রকল্প নেয়া প্রয়োজন।
বৈশাখে আগাম বন্যায় হাওরের ফসল তলিয়ে গেলেও ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সেখানে সেচ দেওয়ার মতো পানি থাকে না নদ-নদীতে। অথচ কয়েক দশক আগেও ওই অঞ্চলের কোনো কোনো নদী দিয়ে সারাবছর বড় বড় লঞ্চ, কার্গো, স্টিমার চলাচল করত। আর তখন হাওর রায় কোনো বেড়িবাঁধও ছিল না। হাওরের পানি নিষ্কাশনের খালগুলোতে শুধু পানি আসার আগে বাঁধ দেওয়া হতো। সেটাও দিতেন এলাকার কৃষকরা নিজ উদ্যোগেই। তাতেই রা পেত হাওরের ফসল।
২০০৮ সালের ১ মে চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুড়ি উপজেলার বেশ কয়েকজন কৃষক ওই এলাকায় কোন কোন নদী ও খালে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পানি থাকে না বলে কী পরিমাণ জমি অনাবাদি থেকে যায় সে চিত্র তুলে ধরেছেন। যদিও সেচ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল রার জন্য ওইসব নদী খননের প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ বলেছেন কি-না তা অনুষ্ঠানের সম্প্রচার করা অংশ থেকে জানা যায়নি। কাছাকাছি সময়েই কয়েকটি এনজিওর উদ্যোগে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘জাতীয় হাওর সম্মেলন’। ওই সম্মেলনের সুপারিশে হাওর অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের বৃহৎ নদীগুলোর নাব্যতা রা যে পরিমাণ ব্যয়বহুল, হাওর এলাকার বেলায় ততটা নয়। বৈশাখে পাহাড়ি ঢলের চাপটা মূলত থাকে সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, কংস, ধনু ও সোমেশ্বরী নদীতে। বেশিরভাগ হাওর তলিয়ে যায় প্রধানত সুরমা, ধনু ও কংস দিয়ে নেমে আসা পানির চাপে। নব্বইয়ের দশকে একবার কংসের মোহনার দিকে কয়েক কিলোমিটার ড্রেজিং করা ছাড়া এ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের অন্য কোনো নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ দরকার এসব নদীর উৎস থেকে খনন করা। মোহনার দিকে শুধু যেসব পয়েন্টে বেশি পলি জমে সে জায়গাগুলোতে খনন করলেই চলে। যেসব এনজিও হাওরাঞ্চলের সমস্যা নিয়ে কাজ করছে তারা এ বিষয়ে একটি স্টাডি করে সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে যে, ওইসব নদী খননে কী পরিমাণ অর্থ দরকার আর এ খননের ফলে লাভের পরিমাণটা কতখানি। এভাবে হিসাব করে দেখাতে পারলে এ কাজে অর্থের অভাব হবে বলে মনে হয় না।
হাওরাঞ্চলের প্রধান নদীগুলো খননের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। আর এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হলে এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটলে ছোট নদী-নালা ও খাল-বিল স্থানীয় উদ্যোগে খনন করা সম্ভব হবে। এ কাজেও ভূমিকা রাখতে পারে বেসরকারি সংস্থাগুলো। স্থানীয় সরকারের মতা বাড়িয়ে তাকেও এ কাজে লাগানো যেতে পারে।
১৯৯৯ সালে সরকার দেশের আটটি এলাকাকে পরিবেশগত বিবেচনায় স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। অঞ্চলগুলোর মধ্যে আছে হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর। পাখি, উদ্ভিদ ও মৎস্যসম্পদসহ পরিবেশ ও জবিবৈচিত্র্যের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক রামসার কনভেনশনের অধীনে ‘রামসার’ এলাকা হিসেবেও তালিকাভুক্ত করা হয় এ দুটি হাওরকে। স্পর্শকাতর এ হাওর এলাকায় পরিবেশের জন্য তিকর কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম চালানোর অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অনেক দেরীতে হলেও এ উদ্যোগ হাওরকে আরো বিপর্যয়ের হাত থেকে রায় সহায়ক হবে।
হাকালুকি হাওরের অবস্থান মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায়। পাঁচটি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত এ হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গকিলোমিটার। এ হাওরে বিল আছে ২৩৮ টির মতো। এগুলো অনেক প্রজাতির দেশী মাছের প্রাকৃতিক আবাস। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, এ হাওর হলো মাদার ফিশারি। এখানে মিঠা পানির মাছ আছে ১৫০ প্রজাতির। আছে ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ। এ হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরণ ও ইকোটুরিজম শিল্প বিকাশের অসাধারণ আধার।
সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার ছোট-বড় ১২০টি বিল নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ২৮০২.৩৬ হেক্টর জলাভূমি। শীতের অতিথি পাখিদের ‘স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে সারাদেশে পরিচিত এ হাওর। প্রতিবছর প্রায় ২০০ প্রজাতির লাখ খানেক অতিথি পাখির অগমণ ঘটে এ হাওরে। আগে এ সংখ্যা ছিল আরো অনেক বেশি। বিশ্বের অনেক বিপন্নপ্রায় প্রজাতির পাখি শীতকালে অস্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তোলে এ হাওরে। এক হিসাব মতে, এ হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এখানকার আইর, চিতল, গাং মাগুর, বাইম, পাবদা, গুলশা মাছ খুবই সুস্বাদু। এ হাওরের শুধু মৎস্যসম্পদ থেকে ১৯৯৯-২০০০ সালে রাজস্ব আয় হয় ৭০ লাখ ৭৩ হাজার ১৮৪ টাকা। এ হাওরের সব জমি এক ফসলি হলেও খুবই উর্বর, ফলে ফলন হয় ভাল। হাওরের অপোকৃত উঁচু ভূমি কান্দা নামে পরিচিত। একসময় কান্দাগুলো ছিল গাছপালায় পরিপূর্ণ। কিন্তু মানুষের অর্থলিপ্সা এবং কৃষিজমির প্রয়োজনে উজাড় করে ফেলা হয়েছে এ প্রাকৃতিক বন। তারপরও অবশিষ্ট হিজল, করচ, বলুয়া বনতুলসী, নলখাগড়া মিলে যে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়েছে এ হাওরকে তা পর্যটকদের অকৃষ্ট করে সহজেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা কম। তবে এ হাওরের কাছাকাছি ধর্মপাশা উপজেলার চাদরা, ডুবাইল, চর হাইজদারচক এবং নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার চর হাইজদা ও ডিঙ্গাপোতা হাওরকে বনায়নসহ পরিকল্পিত উন্নয়নের আওতায় আনা গেলে পর্যটন এলাকা হিসেবে এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।
হাওরাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিদ্যমান ইজারা প্রথা বাতিল করা জরুরি। কেননা বিল (হাওরের নিচু সামান্য অংশ) ইজারা নিয়ে প্রভাবশালী ইজারাদাররা কেবল ওই বিলে মাছ ধরার অধিকারের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে বিশাল হাওরের তাবৎ জমি, জল, উদ্ভিদ, পাখিসহ সব সম্পদের মালিক বনে যায়। ২০০৯ সালে প্রণীত জলমহাল ব্যবস্থাপনানীতিমালায় ‘জাল যার জল তার’ নীতি অনুসরণের কথা উল্লেখ থাকলেও এই নীতি বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। সাধারণভাবে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে ইজারাদাররা তাদের লিজ নেওয়া বিলের সীমানার বাইরেও বিস্তৃত হাওরজুড়ে তাদের দখলদারিত্ব কায়েম করে। এ কাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও মতাসীন দলের নেতৃত্বের প্রশ্রয় পায়। এর ফলে ইজারাদাররা এতোটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, হাওরের ভাসান পানিতে (সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া বিলের বাইরের উন্মুক্ত জল) সাধারণ জেলেদের মাছ ধরার সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা সংশ্লিষ্ট জমির মালিকরাও নিজেদের জমির কাছে ঘেঁষতে পারেন না। কোনো কোনো হিংস্র-লুটেরা ইজারাদার এমনকি শুকনো মৌসুমেও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে জোর করে মাছ ধরে নিয়ে যায়। হাওরের জলাশয় ও মৎস্যসম্পদের উন্নয়ন এবং কৃষক ও মৎস্যজীবীদের অধিকার সংরণের স্বার্থে এই দস্যুতামূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন