বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১১

আল-বদর বাহিনীর মাস্টার প্লান অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যা

ঢাকায় বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গভর্নর হাউসে এক সভায় দাওয়াত দিয়ে নিয়ে তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানী বাহিনী ও ঘাতক আল-বদরদের। একই কৌশলে দেশের প্রধান শহরগুলোতেও বুদ্ধিজীবীসহ শিতি লোকদের স্থানীয় সার্কিট হাউস বা কোনো সরকারি অফিসে আমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করে এ দেশকে সম্পূর্ণ মেধাশূন্য করার চক্রান্ত ছিল ঘাতকদের। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ দৈনিক আজাদ-এ ‘আর একটা সপ্তাহ গেলেই ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সবাইকেই মেরে ফেলত—বদর বাহিনীর মাস্টার প্লান’ শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে এ পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। এ পরিকল্পনা তারা ঠিক ঠিক মতো কার্যকর করতে না পারলেও যেটুকু করেছে তার বিবরণ পড়েই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে তখন বিশ্ববাসী।
একাত্তরের ডিসেম্বরে চূড়ান্ত পরাজয়ের মাত্র কয়েক দিন আগে বদর বাহিনীর হায়েনারা ঢাকায় শত শত বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নৃশংস নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে কয়েকটি বধ্যভূমিতে। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি দৈনিক আজাদে অধ্যাপিকা হামিদা রহমানের লেখা ‘কাটাসূরের বধ্যভূমি’ শীর্ষক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা ছিল রায়ের বাজার বধ্যভূমির প্রত্যদর্শীর বিবরণ। সেলিনা পারভীন, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজউদ্দিন হোসেন, ড. আলীম চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের লাশ পাওয়া যায় সেখানে। দৈনিক আজাদের ওই নিবন্ধে বলা হয়, ‘মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে। প্রতিটি জলার পাশে পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যে মৃত কঙ্কাল স্যা দিচ্ছে কত লোক যে এই মাঠে হত্যা করা হয়েছে।’
বুদ্ধিজীবী হত্যার আরেকটি বধ্যভূমি হলো শিয়ালবাড়ি, যেখানে পড়ে স্থাপন করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি সম্পর্কে আনিসুর রহমানের লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক পূর্ব দেশ-এ। এতে বলা হয় ‘‘সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম। আমার যদি চেতনা না থাকতো। এর চেয়ে যদি হতাম কোনো জড়পদার্থ। তাহলে শিয়ালবাড়ির ঐ বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতোটা নিচ ধারণা করতে পারতাম না। …অথবা যদি না যেতাম সেই শিয়ালবাড়িতে। তাহলে দেখতে হতো না ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়কে। …ক’ হাজার লোককে সেখানে হত্যা করা হয়েছে? যদি বলি দশ হাজার, যদি বলি বিশ হাজার, কি পঁচিশ হাজার তাহলে কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? …আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ন বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল।”
আল-বদরদের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের এতো লাশ ওই দুটি বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় যে, তাদের দাফন করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ বিষয়ে ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ দৈনিক বাংলায় কালো বর্ডার দেওয়া হেডিংয়ে মোটা অরে লেখা এক আবেদনে বলা হয়েছিল, ‘জামাতে ইসলামীর বর্বর বাহিনীর নিষ্ঠুরতম অভিযানে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাদের অসংখ্য লাশ এখনো সেইসব নারকীয় বধ্যভূমিতে সনাক্তহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। …এ পর্যন্ত তাঁদের পূর্ণ মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করা যায়নি।’
আল-বদরদের আরেকটি অবিশ্বাস্য নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরা হয় ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক পূর্বদেশে এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ‘হানাদার পাকবাহিনীর সহযোগী আল-বদরের সদস্যরা পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের পর যখন পালিয়ে গেল তখন তাদের হেডকোর্টারে পাওয়া গেল এক বাস্তা বোঝাই চোখ। এদেশের মানুষের চোখ। আল-বদরের খুনিরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে তুলে বস্তা বোঝাই করে রেখেছিল।’
See also chandan64kalantor.wordpress.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন